সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (ইসি) এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে বহুল আলোচিত নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাবিত আইনটি পাস হয়েছে। গতকাল জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ পাসের জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। অল্প সময়ে বড় কোনো পরিবর্তন ছাড়াই তড়িঘড়ি করে বিলটি পাস হওয়ায় ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে।

কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের মধ্য দিয়ে পুরোনো পদ্ধতিকে নতুন মোড়ক দেয়া হয়েছে। এই আইন দ্বারা সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। সুবিধাভোগীরা অতীতে যেমন অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে নামকাওয়াস্তে কমিশন গঠন করে সুবিধাভোগ করেছে, নতুন আইনের মধ্য দিয়ে তারা সেই সুবিধা ভোগ করবে। এ জন্যই এই আইন পাস করা হয়েছে।

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যে আস্থার সংঙ্কট তৈরি হয়েছে, এই আইন থেকে তার উত্তরণ ঘটবে না, বরং এর ব্যর্থতা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। যদিও অনেকে বলছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো আইন করতে পারিনি। এটি আমাদের ব্যর্থতা। আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও দীর্ঘদিন পর আমরা আইন করেছি। এটি দেশের জন্য ভালো, গণতন্ত্রের জন্য ভালো, রাজনীতির জন্যও ভালো। আইন গঠনে সমালোচনা হচ্ছে বা সমালোচনা থাকতেই পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, ‘আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি সর্বজনীন আইন পাস করবেন। কোনো ধরনের পাশকাঠি করবেন না। কিন্তু আমরা দেখলাম, কারো সাথে আলাপ-আলোচনা না করেই তড়িঘড়ি করে আইন পাস করা হলো।

এই আইনের মাধ্যমে পুরোনো পদ্ধতিকে নতুন মোড়ক দেয়া হয়েছে। নতুন পোশাক পরানো হয়েছে। এই আইন দ্বারা সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এই সুবিধাভোগীরা অতীতে যেমন অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে নামকাওয়াস্তে কমিশন গঠন করে সুবিধা ভোগ করেছে, নতুন আইনের মধ্যে দিয়ে তারা সেই সুবিধা ভোগ করবে। এ জন্যই এই আইন পাস করা হয়েছে। এই আইন থেকে ভালো কিছু আশা করা সম্ভব নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষমতাসীন (আওয়ামী লীগ) নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্যই তড়িঘড়ি করে আইন পাস করেছে। নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, এই আইন থেকে তার উত্তরণ ঘটবে না, বরং এর ব্যর্থতা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’

জানা যায়, অনুসন্ধান কমিটিতে রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুই ‘বিশিষ্ট নাগরিকের’ মধ্যে একজন নারীকে রাখার বাধ্যবাধকতা রেখে বহুল আলোচিত নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের প্রস্তাবে সায় দিয়েছে জাতীয় সংসদ।

আলোচিত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ গতকাল জাতীয় সংসদে পাসের প্রস্তাব করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। পাস হওয়া বিলে সার্চ কমিটির কাজ ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে, যা খসড়ায় ১০ কার্যদিবস ছিল।

এর আগে বিলের ওপর দেয়া জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর নিষ্পত্তি করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। জাতীয় পার্টি, বিএনপি, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির সংসদ সদস্যরা বিলের ওপর এসব প্রস্তাব দেন। প্রথমে বিলের নাম ছিল, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল’। সংসদে সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে এখন নাম হয়েছে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল’।

ইসি গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে নাম সুপারিশের জন্য যে সার্চ কমিটি থাকবে, সেখানে একজন নারী থাকবেন। বিলে বলা ছিল— রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন, যার সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক। সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। এখন রাষ্ট্রপতির মনোনীত ওই দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে একজন নারী রাখার বিধান যুক্ত হলো।

এছাড়া বিলের ওপর বিভিন্ন শব্দ ও ছোটখাটো কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সংসদ সদস্যদের ৬৪টি সংশোধনী প্রস্তাবের মধ্যে ২২টি আইনমন্ত্রী গ্রহণ করেন, যা সংসদের ভোটে পাস হয়। সংশোধনীগুলো গ্রহণের সময় আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এতগুলো সংশোধনী আগে কখনো গ্রহণ করা হয়নি’। বিলটি পাসের সময় জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা অভিযোগ করেন, খসড়া আইনটি ‘তড়িঘড়ি করে’ আনা হয়েছে।

এর জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘গত ১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতির সাথে সংলাপ করে। যারা সংলাপে যাননি এবং গেছেন তারা সবাই আইনের কথা বলেছেন। রাষ্ট্রপতি আইনের বিষয়ে তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। আমরা তড়িঘড়ি করিনি। এ আইনের কথা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালেই এই আইনের কথা উঠেছিল।’ এই বিল নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরের সমালোচনার জবাব দেন আইনমন্ত্রী।

তিনি আরও বলেন, ‘এখন রাষ্ট্রপতি এই বিলে সই করলে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। প্রথমবারের মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইন পাবে বাংলাদেশ।’ দেশের পরবর্তী নির্বাচন কমিশন এই আইনের অধীনেই গঠন করা হবে, যদিও বিলটি নিয়ে রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের নানামুখী সমালোচনা রয়েছে।

এর আগে গত রোববার বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে বিলটি পরীক্ষা করে সাতদিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। বুধবার দুটি পরিবর্তনের সুপারিশসহ প্রতিবেদন সংসদে তোলেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার।

সংসদে উত্থাপিত বিলে সিইসি ও কমিশনারদের যোগ্যতা সংক্রান্ত ৫(গ) ধারায় বলা ছিল— সিইসি ও কমিশনার হতে গেলে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা-সরকারি বা বেসরকারি পদে তার অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই ধারায় সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা-সরকারি বা বেসরকারি পদের পাশাপাশি ‘স্বায়ত্তশাসিত ও পেশায়’ যুক্ত করার সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। তা সংসদে গৃহীত হয়েছে।

এর ফলে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে এমন ব্যক্তিদের সার্চ কমিটি সুপারিশ করবে, যাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা-সরকারি বা বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা আছে। আর অযোগ্যতার ক্ষেত্রে ৬ (ঘ) ধারায় বলা ছিল— নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে সিইসি ও কমিশনার হওয়া যাবে না। এখানে দুই বছরের কারাদণ্ড উঠিয়ে দিয়ে শুধু কারাদণ্ডের সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি।

অর্থাৎ, নৈতিক স্খলন ফৌজদারি অপরাধে যেকোনো মেয়াদের সাজা হলেই সিইসি বা কমিশনার হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এ সংশোধনী প্রস্তাবও সংসদ গ্রহণ করেছে। এ কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে।

আইনে বেঁধে দেয়া যোগ্যতা-অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। এ অনুসন্ধান কমিটি সিইসি ও কমিশনারদের প্রতি পদের জন্য দুজন করে ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। কমিটির গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে জাম দিতে হবে। সার্চ কমিটি সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ্যদের অনুসন্ধানের জন্য রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে।

এতদিন আইন না হওয়ায় প্রতিবারই ইসি গঠনের সময় শুরু হয় বিতর্ক। তা এড়াতে ২০১২ সালে নতুন কমিশন নিয়োগের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সার্চ কমিটি নামে একটি মধ্যস্থ ফোরাম তৈরি করেন, সেটি নিয়েও পরে বিতর্ক হয়। এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে একজন বিচারপতির নেতৃত্বে বিশিষ্ট কয়েকজন নাগরিককে নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করেন।

ওই সার্চ কমিটি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার হতে যোগ্যদের নামের একটি তালিকা তৈরি করে। সেই তালিকা থেকে একজন সিইসিসহ অনধিক পাঁচজন কমিশনার নিয়োগ দেন। এরপর রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ২০১৭ সালে সেই পদ্ধতিই অনুসরণ করেছিলেন। এবারো একই পদ্ধতিতে এগিয়ে যেতে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ শুরু করেন।

কিন্তু সংলাপে অংশ নেয়া ২৫টি দলের প্রায় সবগুলো ইসি গঠনে স্থায়ী সমাধান হিসেবে আইন প্রণয়নের ওপর জোর দেয়। আলোচনায় রাষ্ট্রপতিও এ বিষয়ে সম্মত হন। সর্বশেষ গত ১৭ জানুয়ারি বিকেলে বঙ্গভবনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ইসি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির এবারের সংলাপ। তার আগে দুপুরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ আইনের খসড়া অনুমোদন দেয়া হয় অনেকটা আকস্মিকভাবে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম আমার সংবাদকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো আইন করতে পারিনি, এটি আমাদের ব্যর্থতা। আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও দীর্ঘদিন পর আমরা আইন করছি। এটি কিন্তু দেশের জন্য ভালো, গণতন্ত্রের জন্য ভালো, রাজনীতির জন্যও ভালো।’ তিনি আরও বলেন, ‘আইন গঠনে সমালোচনা হচ্ছে বা সমালোচনা থাকতে পারে। এই আইন যে আগামী দিনে পরিবর্তন করা যাবে না বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। আলোচনার মধ্যে দিয়ে সব কিছু করা সম্ভব।’